‘লিঙ্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণা

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে চাকরি হারিয়েছেন ২১ লাখ ৮৫ শতাংশই নারী

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রায় ২১ লাখ লোক কর্ম হারিয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী। এ বিপুলসংখ্যক নারী চাকরি হারানোর ঘটনা মোট চাকরি হারানোর প্রায় ৮৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রায় ২১ লাখ লোক কর্ম হারিয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী। এ বিপুলসংখ্যক নারী চাকরি হারানোর ঘটনা মোট চাকরি হারানোর প্রায় ৮৫ শতাংশ। গতকাল রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। মাত্র ১৯ শতাংশ নারী বর্তমানে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। যদিও অর্থ বা সম্পদের ওপর নারী ও পুরুষের প্রভাব আপাতদৃষ্টিতে একই রকম, তবে ব্যয় সংকোচনের ক্ষেত্রে নারীরাই প্রথম শিকার হন। গবেষণা অনুযায়ী, কয়েক বছর আগেও প্রতি মাসে প্রায় ৯ হাজার নারী কাজের সন্ধানে বিদেশে যেতেন। তবে গত দুই-তিন বছরে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে সাড়ে ৪ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক ক্ষেত্রেও নারীর উন্নয়নের গতি কমে গেছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আগে অর্জিত অগ্রগতিও হুমকির মুখে পড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে নারীর কর্মসংস্থান হ্রাস ও উন্নয়নের গতি কমে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত। জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য দূর করে নারীর পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট এবং এফএফডি-ফোর ফলাফলের অগ্রগতি’ শীর্ষক পরামর্শসভায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ‘এসডিজি বিষয়ক নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’। আয়োজনে সহযোগিতা করে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএন উইমেন’।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংগঠন ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং। ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেশন প্রোগ্রাম পরিচালক মারিয়া স্ট্রিডসম্যান সম্মানীয় অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বর্তমান সরকার নানা সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছে। আমরা চাই জেন্ডার ইস্যু প্রথমের দিকে থাকুক। গত দেড় দশকে আমরা অনেকখানি এগিয়েছি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। আমাদের সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে ন্যূনতম কিছু প্রয়োগ যদি আমরা না দেখি তাহলে আমরা কিন্তু কষ্ট পাব। আমি শুধু নারী কমিশনের কথা বলছি না। স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি এমনকি সংবিধান ইত্যাদির বিষয়ে যে আলোচনা চলছে, তার ভেতরেও নারীদের বিষয়কে একটি মূলধারার বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে। এটা শুধু নারীর বিষয় না এটা বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়। এটা উন্নয়নের বিষয় শুধু না, এটা ন্যায্যতারও বিষয়। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথ্য সরকারের কাছে থাকা উচিত। জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নে বড় বাধা তথ্যের অসংগতি বা সামষ্টিক ডাটা। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের শ্রমবাজার সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে তথ্য থাকার কারণে বাজেটেও এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের নারীদের জন্য বাজেট পর্যাপ্ত নয়। যেটুকু দেয়া হয় সেখানেও কাঠামোগত বিভিন্ন সমস্যা থাকে।’

ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ‘এসডিজি ৫ (জেন্ডার সমতা) অর্জন করতে নতুন ধরনের অর্থায়নের পদ্ধতি ও সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি নারীদের বরাদ্দে যে ঘাটতি রয়েছে, তা দূর করতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের আন্তর্জাতিক রূপরেখা হিসেবে আদ্দিস আবাবা অ্যাকশন এজেন্ডা যেভাবে পথনির্দেশ দেয়, সেই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যদি আমরা চলি, তাহলে সামনের চতুর্থ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন সম্মেলন (৩০ জুন থেকে ৩ জুলাই স্পেনে অনুষ্ঠিত হবে) একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় বড় ধরনের পরিবর্তনগুলো আরো দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ফলে উন্নয়নের অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো শিশু পেছনে পড়ে থাকবে না।’

ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেশন প্রোগ্রাম পরিচালক মারিয়া স্ট্রিডসম্যান বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই বাজেটে পুরুষ প্রাধান্য থাকে। তবে নারীর অধিকারকে প্রাধান্য দিলে অন্য রকম মূল্যবোধ তৈরি হয় একটি দেশের জন্য। তাই পরিবর্তন দরকার। সমস্যা আছে বলেই এখনো আলোচনা চলছে। পৃথিবীর সব দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুইডেনেও হয়। তবে সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। এখন বাংলাদেশে সংস্কারের সময় চলছে। এটাই সর্বোচ্চ সময় নারীদের জন্য ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার।’

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নারীর উন্নয়নে দৃশ্যমান জায়গায় প্রাধান্য দিচ্ছি। নারীর জন্য অদৃশ্য হুমকির জায়গায় কাজ করা দরকার। ক্ষমতায়নে ডিজিটাল লিটারেসি, আইসিটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর আরো প্রবেশগম্যতা প্রয়োজন। প্রান্তিক গোষ্ঠীসহ ন্যাশনাল ডেটাসেট বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ না। এ কারণে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে এগোতে পারছি না।’

অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপসচিব তাসনিম জেবিন বিনতে শেখ এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফেরদৌসি সুলতানা বক্তব্য দেন। ইউএন উইমেনের জেন্ডার পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রোগ্রাম বিশ্লেষক নুবায়রা জেহিন ‘বাংলাদেশে জেন্ডার প্রতিক্রিয়াশীল বাজেট: সংক্ষিপ্ত পরিসর’ শীর্ষক উপস্থাপনার মাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নের বর্তমান চিত্র তুলে ধরেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সেক্রেটারি রেখা সাহা লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চাহিদা ও অর্থায়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বাজেটে নারীদের জন্য বৃহত্তর প্রতিনিধিত্ব ও কোটা সংরক্ষণের জোরালো আহ্বান জানান।

আরও