দেশের ব্যাংক খাতে মেয়াদি আমানতের সুদহার এখন ১২-১৩ শতাংশ। আমানতের এত উচ্চ সুদ গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। তবে উচ্চ এ সুদহারও এখন আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। গত অর্থবছরের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ৫৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছে ৩৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমানত বৃদ্ধির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নয়টি বেসরকারি ব্যাংককে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ধার দেয়া হয়েছে নতুন টাকা ছাপিয়ে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির আওতায় জোগান দেয়া হয়েছে আরো ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। তারল্য সহায়তা হিসাবে দেয়া এসব অর্থ দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত হিসাবে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে, সেটি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়া আমানতের চেয়েও কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোগান দেয়া অর্থও গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ব্যাংক চলে আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে। গ্রাহকরা চাওয়া মাত্র ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন, এটিই মূলমন্ত্র। স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্ধশতাব্দী এ মূলমন্ত্র দেশে যথাযথভাবে চর্চিত হলেও গত কয়েক বছরে তার ছেদ পড়েছে। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের পর পর দেশের প্রায় এক ডজন ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব না হলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আস্থার ঘাটতির কারণে দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রচুর টাকা বের হয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। মাস শেষে চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের হাতেও সঞ্চয় করার মতো অর্থ থাকছে না। এসবের প্রভাবে ব্যাংকে আগের মতো আমানত আসছে না।’
ব্যাংকে আমানত প্রবাহ বাড়াতে হলে আস্থা ফেরানোর বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে বলে মনে করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কিছু ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতির কারণে আস্থার যে ছেদ পড়েছে, সেটি দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতেই হবে। অন্যথায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে না। অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতি নজর দিতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ওই সময় আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। ওই বছরের ডিসেম্বর শেষে আমানতের স্থিতি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭০ শতাংশে। ২০২৪ সালের জুন শেষে আমানতের স্থিতি ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ওই সময় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৫ শতাংশে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আমানতের স্থিতি দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩১৪ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে আমানতের প্রবৃদ্ধি নেমে আসে মাত্র ১ দশমিক ৯৮ শতাংশে।
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় সামনের সারির ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার ২-৩ শতাংশেও নামিয়ে আনে। কিন্তু এরপরও আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে ঋণের ৯ শতাংশের সর্বোচ্চ সুদসীমা তুলে নেয়া হয়। একই সঙ্গে বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার। এরপর থেকে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ক্রমাগত বেড়েছে। বর্তমানে বেশির ভাগ ব্যাংকের নতুন ঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশে ঠেকেছে। আর আমানতের সুদহারও বেড়ে ১২-১৩ শতাংশে উঠেছে। দুর্বল ও চতুর্থ প্রজন্মের কোনো কোনো ব্যাংক এর চেয়েও বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আমানতের সুদহার উচ্চ হলেও সেটি মূল্যস্ফীতির তুলনায় খুব বেশি নয় বলে মনে করেন শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। ওই সময় কোনো গ্রাহক আমানতের বিপরীতে ১২ শতাংশ সুদ পেলেও সেটি তার জন্য লাভজনক ছিল না। কারণ আমানতের সুদহার থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে যে ১ শতাংশ থাকে, সেটিও সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সে চলে যায়। এ অবস্থায় ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে গ্রাহকরা জমি কিংবা অন্য খাতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী হবেন, এটিই স্বাভাবিক।’
মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘গত এক বছরে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে গণমাধ্যমে যত নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৩ বছরেও সেটি হয়নি। এত নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে মানুষ কোন ভরসায় ব্যাংকে টাকা রাখতে আসবে। গণমাধ্যমে এমন সংবাদও আসছে যে অমুক ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারছে না, শাখার ব্যবস্থাপক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, গ্রাহকরা শাখায় গিয়ে হইচই করছে। কোনো দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিলে সে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন এসব সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় সংকট থেকে উত্তরণের পাশাপাশি ব্যাংকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফেরানোটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’