বিদ্যমান সম্পর্ক সামনের দিনগুলোতে আরো এগিয়ে নেবার ব্যাপারে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা। আজ ১৫ বছর পর অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক প্রসঙ্গে ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক (এফএসএলসি) বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয় পর্যালোচনা এবং দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। সভায় উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়াদি পর্যালোচনা করে, এবং আরো সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে। উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে এবং দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতায় নতুন গতি প্রদানের ওপর জোর দেয়। সর্বশেষ এফএসএলসি ২০১০ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এফএসএলসির আলোচনার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বার্তা পৌছে দেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সমীপে তার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বিদ্যমান সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেবার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা তার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
এফএসএলসিতে আলোচিত বিষয় প্রসঙ্গে মো. জসীম উদ্দিন বলেন, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। সকল প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম লক্ষ্য। এ প্রেক্ষিতে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক সামনের দিনগুলোতে আরো এগিয়ে নেবার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এছাড়াও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছি। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের রফতানি বাড়াতে বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং শুল্ক বাধা দূরীকরণ ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বৃদ্ধিকরণের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করার ওপর আমি গুরুত্বারোপ করি। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্যও আলোচনা হয়েছে, যাতে প্রযুক্তি, উন্নত প্রজাতি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও বন্যা প্রতিরোধে দু দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর জোর দেয়া হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনারা জানেন যে সাম্প্রতিককালে দুদেশের মধ্যে সরাসরি শিপিং রুট চালু হয়েছে এবং সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ ও ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই দুদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু সম্ভব হবে।
মো. জসীম উদ্দিন বলেন, আমরা উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি এবং এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক শিক্ষা বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। পাশাপাশি সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও আলোচনায় এসেছে। দুই দেশের শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক ও শিক্ষাবিদদের সফরের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উভয় পক্ষ থেকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমি পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি, যেমন: আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশী সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও অগ্রসর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এ লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা সার্কের আওতায় সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরে এর পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানিয়েছি, যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া যায়। আমরা ওআইসি সনদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে কাজ করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় দুই দেশই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। আমি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের মিয়ানমারে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সমর্থন কামনা করি।
তিনি ব্রিফিংয়ের শেষে বলেন, আমি শুরুতে বলেছি, এফএসএলসি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে প্রেক্ষিতে উভয় দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের চলমান সহযোগিতামূলক কার্যক্রমগুলোর বিষয়ে আজকের এফএসএলসিতে করা সার্বিক আলোচনা পরবর্তীতে বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিতে এবং আমাদের অগ্রাধিকারমূলক ইস্যুগুলোতে পারস্পরিক স্বদিচ্ছা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে সমাধান করতে অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।