প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চট্টগ্রামের উপজেলা রাঙ্গুনিয়া। এর বুক চিরে বয়ে গেছে কর্ণফুলী ও ইছামতী নদী এবং শিলক ও ঝংকার খাল। এসব নদী ও খাল ঘিরে গড়ে উঠেছে অন্তত ১০টি বালুমহাল। এগুলো থেকে প্রতি বছর উত্তোলন হয় বিপুল পরিমাণ বালি। একসময় এসব বালুমহালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদের পরিবারের হাতে। প্রভাব খাটিয়ে নামমাত্র মূল্যে বছরের পর বছর ইজারা নেয়া হয় এসব মহাল। নিয়ম লঙ্ঘন করে তোলা হয় অনুমোদনের কয়েক গুণ বালি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আত্মগোপনে চলে গেলেও বালুমহালগুলো এখনো তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণেই।
প্রশাসনের সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পার্বত্য রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার সঙ্গে সংযুক্ত। বিভিন্ন নদী ও খালের মাধ্যমে পাহাড়ি বালি খাল ও নদীতে আসায় সেগুলোর খুবই চাহিদা রয়েছে। প্রায় সারা দেশের নির্মাণকাজে এ অঞ্চলের বালি ব্যবহার হওয়ায় দাম অনেক বেশি থাকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, হাছান মাহমুদের প্রভাবের কারণে এ অঞ্চলের বালুমহালগুলোর অলিখিত মালিক ছিলেন তারই ভাই এরশাদ মাহমুদ। নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে বালি উত্তোলন করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন হাছান মাহমুদসহ তার পরিবারের সদস্যরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত মার্চে রাঙ্গুনিয়ার সাতটি বালুমহালের ইজারার দরপত্র ঘোষণা করে। এক বছরের জন্য ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৩৭ ঘনফুট বালি উত্তোলনের দরপত্র দেয়া হয়। প্রতি ঘনফুটের জন্য সম্ভাব্য দর নির্ধারণ করা হয় গড়ে ৪ টাকা ৮৭ পয়সা। অথচ প্রায় দেড় দশক ধরে হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা প্রতি ঘনফুটের জন্য কেবল ৩০ পয়সা দিতেন সরকারকে। তাছাড়া নির্ধারিত পরিমাণের চেয়েও কয়েক গুণ বালি তুলে বিনষ্ট করা হয়েছে কর্ণফুলী নদী, শিলক খাল, ইছামতী নদী, ঝংকার খালের প্রাণ-প্রকৃতি। নিয়ম ভেঙে অবাধে বালি উত্তোলনের কারণে দেখা দেয় নদীভাঙন। ফলে সৃষ্ট সংকট নিরসনে বাধ্য হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড হাতে নেয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় অবাধে বালি উত্তোলনের ফলে কর্ণফুলীসহ বেশ কয়েকটি নদী ও খাল ভাঙনপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। তাই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমাতে ২০১৮ সালে ‘চট্টগ্রাম জেলাধীন রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলা এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী ও ইছামতী নদী এবং শিলক খালসহ অন্যান্য খালের উভয় তীরের ভাঙন হতে রক্ষা’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ৩৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অধীনে নদী ও খালগুলোর ভেতরে জেগে ওঠা চর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণসহ নদীর পাড় রক্ষায় ব্লক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। মূলত নিয়মতান্ত্রিকভাবে বালি উত্তোলন না হওয়ায় নদীপাড়ে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নসহ কর্ণফুলী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি ভাঙনের কবলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাই এরশাদ মাহমুদসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের অবৈধ বালির ব্যবসা চলছেই। কর্ণফুলী ও ইছামতী নদী থেকে বালি তুলতে তাদের সহায়তা করছেন স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা। আত্মগোপনে থাকলেও নতুন একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তিনামার মাধ্যমে বালি ব্যবসা জিইয়ে রেখেছেন হাছান মাহমুদের পরিবার। সাবেক এ মন্ত্রীর ভাই এরশাদ মাহমুদ তার শ্যালক মুহাম্মদ ফয়সাল চৌধুরীর মাধ্যমে বালির ব্যবসা পরিচালনা করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফয়সাল চৌধুরী চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করেন। এমনকি ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ফয়সাল ব্রাদার্সের ব্যবসায়িক পার্টনার ও লিগ্যাল অ্যাডভাইজারকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেন তিনি। ফলে আত্মগোপনে থেকেও হাছান মাহমুদের ভাই এরশাদ মাহমুদ ও তার শ্যালক রাঙ্গুনিয়ায় বালি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এরশাদ মাহমুদ ও তার শ্যালক মুহাম্মদ ফয়সাল চৌধুরীকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাছান মাহমুদের পরিবারের অর্থ-বিত্তের মূল উৎস ছিল বালি ব্যবসা। ৫ আগস্টের পর পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে গেলেও এখনো ভিন্ন নামে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বালির ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা। কৌশলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে দামি এ বালির ব্যবসার আধিপত্য ধরে রেখেছেন তারা।’
অভিযোগ উঠেছে, অপরিকল্পিত বালি উত্তোলনের ফলে গোডাউন ও বগাবিলি সেতু ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাছাড়া নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বাংলা বছর ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত যে পরিমাণ বালি উত্তোলনের শর্ত থাকে, রাঙ্গুনিয়ার ইজারাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি মাসেই একই পরিমাণ বালি উত্তোলন করে।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের অধীনে উত্তোলনের পর জনস্বার্থে ব্যবহারের পর বাকি ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৮৯০ ঘনফুট বালি মাত্র ৩০ পয়সা (প্রতি ঘনফুট) দরে সংগ্রহ করে মেসার্স ফয়সাল ব্রাদার্স ও নঈমীয়া এন্টারপ্রাইজ। দুটি প্রতিষ্ঠানই এরশাদ মাহমুদের শ্যালক মুহাম্মদ ফয়সাল চৌধুরীর মালিকানাধীন। মূলত কোনো দরপত্র ঘোষণা না করেই ‘রাঙ্গুনিয়া ড্রেজিং ও ড্রেজড মেটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটি’র সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এসব বালি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া হয়। এভাবে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা রাঙ্গুনিয়াসহ আশপাশের এলাকাগুলোর নদী ও খাল থেকে উত্তোলিত বালি বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে। বর্তমানে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ব্যবসায়িক সুবিধা দেয়ার কৌশল নিয়ে পরিবারটি বালুমহালের ব্যবসায় এখনো যুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙ্গুনিয়ার ইছামতী-২ বালুমহালের সর্বশেষ দেয়া বালির সম্ভাব্য সরকারি মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি ঘনফুট ৩ টাকা ২০ পয়সা, ইছামতী-৩ বালুমহালের প্রতি ঘনফুটের দর ধরা হয়েছে ২ টাকা ৪২ পয়সা, ইছামতী-৪ বালুমহালের প্রতি ঘনফুটের দাম ২ টাকা ৫ পয়সা, শিলক খাল বালুমহালের প্রতি ঘনফুট ৫ টাকা ৩৪ পয়সা, ঝংকার খাল বালুমহালের প্রতি ঘনফুট ৩ টাকা ২৩ পয়সা, নারিশ্চা বালুমহালের প্রতি ঘনফুটের দাম ৪৭ টাকা ৩৭ পয়সা ও ফকিরাঘাট বালুমহালের প্রতি ঘনফুটের সম্ভাব্য দাম ধরা হয়েছে ৯ টাকা ৯৬ পয়সা। আগামী ১৪৩২ বাংলা সনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা এসব বালুমহালে অংশগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দেশের সবচেয়ে ভালোমানের বালুমহালের প্রতি ঘনফুট বালির প্রতিযোগিতামূলক দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশা করছেন প্রশাসকের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে ৯ এপ্রিল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দায়িত্ব নেয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কামরুল হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আগের ইউএনও মাহমুদুল হাসানকে সম্প্রতি বরিশালে বদলি করা হয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বালুমহাল নিয়ে নানা সংকট, রাজনৈতিক টানপড়েন ছিল। দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল যেন একেবারেই স্বাভাবিক। ২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পর শুধু ব্যবস্থাপনার বাইরে থাকা পৌনে ৩ কোটি টাকার বালি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করেছি।’ প্রশাসনের নজরদারিসহ নিয়ম অনুযায়ী ইজারা ও তদারকি করলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি অবাধে বালি উত্তোলনের হারও কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।