আট দশকের যাত্রায় রাজনীতিতে অন্যতম মুখ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভাব জামায়াতের

রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার আট দশকেরও অধিক সময় পার করেছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো জোটে কখনো বা বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে মাঠে নেমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে দলটি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার আট দশকেরও অধিক সময় পার করেছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো জোটে কখনো বা বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে মাঠে নেমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে দলটি। তবে বরাবরই ছিল দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরের শক্তি। পেয়েছে ‘কিং মেকারের’ তকমাও। প্রথমবারের মতো এবারই জাতীয় রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আসন্ন নির্বাচনেও ধর্মভিত্তিক দলটির প্রভাব জারি থাকবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদীর হাত ধরে ১৯৪১ সালে লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে শুরু হওয়া সামাজিক সংগঠনটিকে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইসলামিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে সমাজের পরিবর্তনই এর মূল উদ্দেশ্য বলে দাবি করত দলটি। সময়ের সঙ্গে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে জামায়াতে ইসলামী। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে দলটি প্রভাব হারাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেন এর ঠিক বিপরীত চিত্র।

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উঠে আসে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। এরশাদ সরকারের অধীনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি আসন পায় দক্ষিণপন্থী দলটি। যদিও ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। বরং বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক পর পরই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়ী হন জামায়াতের প্রার্থীরা। সে সময় বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থনও করেন তারা।

একসময় বিএনপিকে দেয়া সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে জামায়াতে ইসলামী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয় তারা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে অবশ্য তিনটি আসন পায়। নির্বাচনের দুই বছর পর আবারো বিএনপির সঙ্গে জোট করে জামায়াত। এ জোটে থেকেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৭ আসন পেয়ে সরকারের অংশ হয়। তারপর দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গেই ছিল জামায়াতে ইসলামী।

পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিএনপির সঙ্গেই আন্দোলন চালিয়ে যায় জামায়াত। অবশেষে ২০২২ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে আসে। যদিও শেখ হাসিনার শাসনের সময়জুড়ে দলের নিবন্ধন বাতিল, প্রভাবশালী নেতাদের ফাঁসি—অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে দলটির। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটার দিন তিনেক আগে দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

এবারই প্রথম নয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরই সূত্র ধরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে সব ধরনের ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে বন্ধ হয়ে যায় জামায়াতেরও সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালেও সেনাশাসক আইয়ুব খানের সময় প্রথমবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয় জামায়াতে ইসলামীকে। দলটি আরো একবার ১৯৬৪ সালে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালের দিকে জিয়াউর রহমান জনসমর্থন আদায়ের জন্য জামায়াতের মতো দলগুলোর সহযোগিতা নিতে থাকেন। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে জামায়াত আবারো ছিটকে পড়ে। সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ায় বিএনপি কিংবা বড় দলগুলোর হাত ধরেই।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যা অতীতে ছিল না। এবার ভোটের হিস্যায় দলটি বেশ প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের প্রভাব বাড়ছে। তবে সেটিকে পুরো জামায়াতের কৃতিত্ব বলা যাবে না। সমাজে ধর্মের প্রভাব বেড়েছে এবং তা কালেক্টিভ। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে স্মার্ট হওয়ায় ইসলামের সামগ্রিক প্রভাবকে নিজেদের বলে তুলে ধরছে দলটি। ফলে পুরো ইসলামিক ঘরানার নেতৃত্বও নিজেদের হাতে বলে দাবি করছে।’

গবেষক আলতাফ পারভেজ আরো বলেন, ‘সমাজের কত শতাংশ মানুষকে জামায়াত প্রতিনিধিত্ব করে তা বোঝা যাচ্ছে না, যেহেতু ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন ছিল না। এবার নির্বাচন হলে এবং তা সুষ্ঠু হলে সেটি বোঝা যাবে। তবে এটি সত্য, শহরের তুলনায় গ্রামে বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে জামায়াতের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে আসন কয়টি পাবে জানি না। তবে ভোটের হার অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক বাড়বে। আমি মনে করি ভোটের হিস্যায় জামায়াত সারপ্রাইজ দেবে।’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে জামায়াতে ইসলামীর। মূলত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচন প্রসঙ্গে দল দুটি ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। শুরুতে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করেছিল বিএনপি। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ নির্বাচনী রোডম্যাপসহ অন্যান্য ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায় বিএনপি। তবে ডিসেম্বর নয়, বরং সংস্কারের পর নির্বাচন দাবি করে বিএনপি থেকে স্পষ্ট ভিন্ন অবস্থান ধরে রাখে জামায়াত। এর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ে দল দুটি এখন দুই মেরুতে কথা বলছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে জামায়াতের আবির্ভূত হওয়ার মুখ্য কারণ তিনটি বলে উল্লেখ করেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথমত, আমরা মনে করি জামায়াত একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল। এর ওপর ভিত্তি করেই আমাদের রাজনীতিবিদদের মনন, বিশ্বাস ও জীবন গড়ে ওঠে। আমরা এটিকে জীবনেরই লক্ষ্য মনে করি। এমন একটি দলে কার ফাঁসি হয়ে গেল কিংবা কে জেলে গেল, তা দিয়ে দুর্বল করা যায় না। এটিই আমাদের অদম্য শক্তির উৎস, যা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো না। দ্বিতীয়ত, আমাদের ওপর দেশব্যাপী যে জুলুম হয়েছে এতে মানুষের মধ্যে সমবেদনা ও সহানুভূতি তৈরি হয়েছে, সেটি এখানে কাজ করেছে। তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদী হাসিনার বিদায়। এতে আমাদের ওপর যে খড়্গ ছিল তা দূর হয়েছে। আমরা মানুষের কাছে যেতে পারছি।’

জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আরো বলেন, ‘রাজনীতির বৃহত্তর কোনো ইস্যুতে হয়তো কোনো কোনো দলের সঙ্গে জোট করেছি, লিয়াজোঁ করেছি। তবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকেছি। কিন্তু কারো আশ্রয়ে ছিলাম না। গত ৫ আগস্টের পর সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তি যেটি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি সেটি নিয়েই সামনে চলার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছি। সামনের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সংগঠনের সব কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের শক্তি নিজস্ব সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনগণের ভালোবাসা। ভোটের রাজনীতিতেও আমরা আশাবাদী। অতীতের নির্বাচনের চেয়ে ২০২৫-২৬-এর নির্বাচনে আমরা বেশি আশাবাদী। সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনসহ অনেক কারণ আছে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আমাদের নির্বাচনী ফলাফল ভালো হবে।’

আরও